আসলামুআলাইকুম, Blog Academy তে লিখছি আমি কামরুজ্জামান রিফাত,আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়,রমজানের খাদ্যাভ্যাস ।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন,হে ঈমানদারগণ,তোমাদের ওপর রোযা ফরজ করা হয়েছে,যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পারো।-সূরা বাকারা (০২) : ১৮৩
নিঃসন্দেহে অন্য মাস অপেক্ষা অধিক মর্যাদাপূর্ণ রহমত,মাগফেরাত আর নাজাতের বার্তা নিয়ে আসে রমজান।
এ মাসের অর্জিত জ্ঞান অন্য সব মাসে প্রয়োগের মাধ্যমে,আমাদের জীবন সুন্দর ও আলোকিত হয়ে ওঠে।
তাই আসন্ন রমজানে নিজেকে সুস্থ ও সুন্দর রাখতে প্রয়োজন খাদ্যাভ্যাস এবং শরীরের বাড়তি খেয়াল রাখা।
এবার রমজান এমন সময়ে হতে যাচ্ছে যে সময় তীব্র গরম পড়তে পারে।যার ফলে রমজানে নিজের সঠিক সময়ে,
শরীরকে সুস্থ রাখতে নিজেকে সঠিক পরিকল্পনা করে নিতে হবে।
নিয়মিত রুটিনে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে রমজান মাসের খাওয়া এবং ঘুমের বদলে যাওয়া অভ্যাস।
তবে আপনি যদি আগে থেকেই পরিকল্পনা করেন এবং আপনার নিয়মিত রুটিন টি সামঞ্জস্য করা শুরু করেন, তাহলে আপনি স্বাস্থ্যসম্মত রমজান উপভোগ করতে পারবেন।
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে রমজানের উপকারিতা
প্রথমেই বলে নেই,যেহেতু কোরআন হাদিসে রোজা নয় সিয়াম এর কথা বর্ননা এসেছে এবং সিয়াম প্রকৃত শব্দ তাই আমরা রোজার পরিবর্তে সিয়াম শব্দটি উল্ল্যেখ্য করব।
- ডায়েটিংয়ের চেয়েও ভালো ফল দেয় সিয়াম।
- ডায়াবেটিস,হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপের এর মত জটিল রোগ গুলোর ঝুঁকি মুক্ত হতে সিয়াম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- সিয়াম বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার যেমনঃপ্রোস্টেট ক্যান্সার,স্টোন ক্যান্সার,কোলন ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধি থেকে নিরাপদ রাখে।
- পেপটিক আলসারের উপসর্গ গুলো রোজা/সিয়াম এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রন হয়।
- আমাদের বয়স বৃদ্ধিতে বয়সজনিত অনেক রোগ হয় যেমনঃআলঝেইমার,ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রম এসব রোগ হতে সিয়াম এর মাধ্যমে বাঁচাতে পারে ।
- রমাজানে আমাদের স্বাস্থ্য ঠিক রেখে চলতে হলে সঠিক নিয়ম মেনে,আমাদের রুটিন করে সঠিক সময়ে খাওয়া,ঘুম এবং নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।
মনে রাখতে হবে রমজানে সঠিক খাদ্যাভ্যাস শরীর সুস্থ রাখবে।
রমজানের খাদ্যাভ্যাস নিয়ম
- রমজান মাসে সাহরি ও ইফতার সময় হলো খাবার গ্রহণের দুটি বিশেষ সময়। সারাদিন কষ্ট করে রোজা রাখার পর,ইফতারে মুখরোচক ভাজাপোড়া খাবার খাওয়া হয়।
মজা লাগলেও এ ধরনের খাবার আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য মোটেও ভালো না। রমজানের খাদ্যাভ্যাস এর ব্যাপারে একটু সতর্ক হওয়া দরকার। এছাড়াও রোজাদারের বয়স ও শারীরিক অবস্থাকে বিবেচনায় রাখতে হবে সাহরি ও ইফতারের খাবার নির্বাচনে ।
রোজার সময়ে আমরা সাধারণত তিন বেলা আমদের খাবার খেয়ে থাকি যথাক্রমে ইফতার, রাতের খাবার এবং সেহরি।
রোজার মাস জুরে সুস্থ থাকতে চাইলে খেয়াল রাখতে হবে আমরা যে সকল খাবার খাবো সেই খাবার যেন স্বাস্থ্যকর,
সহজপাচ্য এবং পুষ্টিকর হয়।
রমজান মাস আসার সাথে সাথে আমরা অতিরিক্ত ভাজাপোড়া ও মসলাযুক্ত খাবারের দিকে ঝুঁকে পড়ি অনেক বেশি।
সবাই আমরা খাদ্য সংযমের এই পবিত্র মাসে নেমে পড়ি এক ধরনের খাবার খাওয়ার প্রতিযোগিতায়।
সারা দিন রোজা পালন করার ফলে পাকস্থলি খুব ক্ষুধার্ত ও দুর্বল থাকে,তার সঙ্গে অতিরিক্ত ভাজাপোড়া ও মসলাযুক্ত খাবার খেয়ে হতে পারে পেটের সমস্যা,মাথাব্যথা,দুর্বলতা,আলসার,অ্যাসিডিটি ও হজমের সমস্যাসহ নানারকম শারীরিক জটিলতা।
রোজায় খুব দামি খাবার খেতে হবে তা নয় বরং সুষম ও সহজপাচ্য পুষ্টিকর খাবার খেলেই খুব সহজেই সুস্থ থাকা যায়।
রমজানের ইফতার খাদ্যাভ্যাস
রমজানের খাদ্যাভ্যাস এ ইফতারের মেন্যু এমনভাবে নির্বাচন করতে হবে তা যেন পরিবারের সবার উপযোগী হয়।
মেন্যুতে রাখা যেতে পারে খেজুর। কারণ খেজুরের সুক্রোজ পানির সঙ্গে মিশে তাৎক্ষণিক প্রাণ শক্তি দেয়।
এর সঙ্গে যে কোনো ন্যাচারাল অ্যানার্জি ড্রিংক যেমনঃ তাজা ফলের রস, ডাবের পানি, লাচ্ছি,তোকমার শরবত,আখের গুড়ের শরবত, লেবুর শরবত ইত্যাদি।
শরবত তৈরিতে মিছড়ি,গুড়,মধু ও ব্রাউন সুগার ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে চিনির পরিমাণ কম দেয়াই শ্রেয়।
সকল প্রকারের মৌসুমি ফল বা এসল ফল দিয়ে প্রস্তুত ডেজার্ট খাবার ও খেতে পারেন,যা দিনের শুরু হতে শেষ রোজা পালন করার পর দেহে যে ভিটামিনস ও মিনারেলসের ঘারতি হয় তার চাহিদা পূরণ করবে।
তাছাড়াও সবজি দিয়ে প্রস্তুত বিভিন্ন রেসিপি যেমন-সবজি স্যান্ডউইচ,সবজি নুডলস, সবজি পাকোরা, সবজি স্যুপ,সবজি রোল ইত্যাদি খেতে পারেন।
পুরো রমজানের ৩০টি দিন রমজানের খাদ্যাভ্যাস এ ডালের বড়া না রেখে মাঝে মাঝে খেতে পারেন। কারণ ডাল শরীরে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে।
রান্নায় তেলের ব্যবহার যতটা পারা যায় কম হয় এটা খেয়াল রাখা জরুরি। তেলের কালার কালো বর্ণ হলে, তেল দ্রুত বদলে ফেলা ভাল।
একই তেলে খাবার বারবার ভাজা হলে তেল কালচে, আঠালো এবং এর স্বাদ ও গুণগত মান তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়।
ইফতারির প্রায় সবার পছন্দের একটি খাবার ছোলা,এটিতে প্রচুর প্রোটিন রয়েছে।
তাই মসলাযুক্ত করে রান্না করা ভুনা ছোলা না খেয়ে কাঁচা ছোলা অথবা সিদ্ধ ছোলার সঙ্গে কাঁচা মরিচ,পেঁয়াজ,শসা,টমেটো ইত্যাদি এক সাথে মিলিয়ে খাওয়া স্বাস্থ্যসম্মত,এর ফলে একইসঙ্গে আপনার শরীরে প্রোটিন এবং ফাইবার পেয়ে যাবেন।
ইফতারিতে খাবার আইটেমে নিয়মিত বাহিরের তৈরি জিলাপি,বুন্দিয়ার পরিবর্তে ঘরে তৈরি মিষ্টান্ন যে কোন রেসিপি
যেমনঃ কাস্টার্ড, ডিমের পুডিং, ফিরনি ফালুদা বানিয়ে খেতে পারেন।
দই চিড়াও খেতে পারেন ইফতারিতে যা্র মধ্যে রয়েছে প্রচুর কার্বহাইড্রেট,প্রোটিন এবং ক্যালসিয়াম।
রাতের খাদ্যাভ্যাস
রোজা রাখার পরে ইফতারি শেষ করার পর অনেকেই সময় মত রাতের খাবার যেতটুকও খাওয়া দরকার তা খায়না অথবা অনেকেই, ইফতারের পর রাতের খাবার না খেয়ে একবারে সেহরিতে খায় এমন অভ্যাস স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
রোজার সময় ছাড়া অন্য সময়ে পরিমিত পুষ্টিকর খাবার বারে বারে গ্রহণ করার জন্য বলা হয়ে থাকে যা স্বাস্থ্যসম্মত।
ঠিক এই বিষয়টিই রোজার সময় এ তিন বেলা খাওয়ার মাধ্যমে তা পূরণ করতে হবে। সারাদিন রোজা রেখে তারাবি নামাজ শেষে,
আপনি যেন ক্লান্তিবোধ না করেন এব একটা ভালো ঘুম হয় তার জন্য রাতের খাবার খেতে হবে পরিমিত পরিমাণে।
রাতের সেই সকল খাবারে যেন কার্বহাইড্রেট, প্রোটিন, ভিটামিনস এবং মিনারেলস বিদ্যমান থাকে সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
যেমন-সামান্য পরিমাণে ভাত, শাকসবজি, মাছ/মুরগির মাংস ১ টুকরো।
গরু বা খাসির মাংস পরিমিত পরিমানে খেতে পারেন,দুধের সাথে অল্প পরিমাণে ভাত বা ওটস রাখতে পারেন,এবং রুটি সবজি, ডিমের সাদা অংশ ইত্যাদি খাবার গুলো স্বাস্থ্যসম্মত রাতের খাবার।
কোমল পানীয় যথাসম্ভব পরিহার করে এ ৩টি সময় মিলে কমপক্ষে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা শরীরের জন্য অনেক ভাল।
রমজানের সাহরি খাদ্যাভ্যাস
অনেকে রমজানের খাদ্যাভ্যাস এ সাহরিতে খাবারের পরিমাণ বহুগুণে বাড়িয়ে দেন সারা দিন খাবার খাওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়না বলে।
আবার অনেকেই কোন কিছুই না খেয়ে অথবা অল্প পরিমানে খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন এর কোনোটাই স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
কারণ,পরের দিনে আপনার কতটুকু প্রাণশক্তি থাকবে,পুরো রোজায় আপনার স্বাস্থ্য কতটুকু ভালো থাকবে তার অনেকটা নির্ভর করে এ সাহরির ওপর।
ফজরের আযান দেওয়ার কিছুটা সময় আগে আপনি যদি সাহরির খাবার টা সেরে ফেলেন তবে,সারা দিন আপনি বেশ কর্মক্ষম থাকবেন এবং বার বার ক্ষিদে,বা তৃষ্ণা পাবে না।
তবে সাহরির খাবার কি রকম হবে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।সাহরিতে এমন কিছু খাবার নির্বাচন করতে হবে যা সহজেই হজম করা যায়।
যেমন- ভাত খুবই সহজপাচ্য, এর সঙ্গে মাছ, সবজি নিতে পারেন। এছাড়া চিড়া,দই, কলা,আম, দুধ-ভাত সাহরির জন্য বেশ উপযোগী খাবার।
তবে তেল যুক্ত খাবার খুব সীমিত এবং চিনির ব্যবহার খাবারে কম রাখাই ভালো।অনেকের সাহরিতে চা/কফি খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে।
তাই এই রোজায় সেই চা/কফি খাওয়ার অভ্যাস পরিত্যাগ করুন। এ সকল চা/কফি অল্প সময়ের জন্য আপনাকে সতেজ রাখলেও পরের দিনে আপনার পানির তৃষ্ণা অনেকগুণ বাড়িয়ে দেবে।
রমজানের খাদ্যাভ্যাস কী খাবেন এবং কী খাবেন না
- রমজানে খাবার তালিকায় খেজুর বা খোরমা অবশ্যই রাখবেন।খেজুর বা খোরমায় রয়েছে শর্করা, চিনি,সোডিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম,ক্যালসিয়াম, ফসফরাস,আয়রন কপার,সালফার,ম্যাঙ্গানিজ,সিলিকন,ক্লোরিন,ফাইবার,যে সকল খাদ্য উপাদান সারা দিন রোজা রাখার পর খুবই দরকারি।
- চিনিযুক্ত খাবার যথাসম্ভব পরিহার করলেই ভালো হয়। চিনিযুক্ত খাবার খুব তাড়াতাড়ি রক্তে চিনির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, এবং শরীরের ওজন বাড়ায়।
- সবজি ও ফল জাতীয় খাবার খেতে হবে বেশি করে। তা না হলে রমজানে কোষ্ঠকাঠিন্য হবে নিত্যসঙ্গী।
- গরমের সময় রমজানে অন্তত ৮ থেকে ১০ গ্লাস পানি না খেলে হজমের সমস্যা হবে। তাই ইফতারের পর থেকে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কিছু সময় পরপর পানি খেতে হবে।
- বেশি বেশি সুষম খাবার খেতে হবে।
- আঁশসমৃদ্ধ খাবার যেমন লাল আটা, ছোলা, বাদাম, বিনস, শস্য, ডাল ইত্যাদি খেতে হবে।
- এগুলো হজম হয় আস্তে আস্তে, তাই অনেক সময় পর ক্ষুধা লাগে।
- কাচা ছোলা খেতে পারেন, তবে তেল দিয়ে ভুনা করে ছোলা না খাওয়া শরীরের জন্য ভাল।
রমজান মাসে মেনে চলবেন
- ইফতারের সময় হঠাৎ করে অধিক পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ করবেন না,এতে অস্বস্তিবোধ ছাড়াও হজমের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- পরিমানের চেয়ে অধিক বা কম সেহরি গ্রহণ করলে শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিতে পারে তাই সে ব্যাপারে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
- রমজান মাস ধূমপান বর্জনের জন্যে আদর্শ সময়। তাই নিজের সুস্থার জন্যে ধূমপান বর্জনের জন্যে এ সময়টি বেছে নিতে পারেন।
- পানি, খেজুর , স্যুপ অথবা সালাদের মতন খাদ্য দ্রুত ক্ষুধা মিটায় তাই এগুলো আগে খেয়ে নিলে বাকি খাবার মাগরিবের নামাজ আদায়ের পর খেতে পারেন। এর ফলে আপনার হজম প্রক্রিয়া ভালোভাবে হবে।
রমজান মাসে একটু ভেবে চিনতে খাওয়া দাওয়া করলে কোন কষ্ট ছাড়াই সাওম পালন করা যাবে। তাই একটু সচেতন হই এবং সুস্থ ও সুন্দরভাবে সাওম পালন করি। শুভ হোক মাহে রমজান।